কাঠের ঘানি ভাঙ্গা সরিষার তেল আমাদের ঐতিহ্যের সঙ্গেই যেন মিশে আছে। একসময় গ্রামবাংলার একমাত্র ভোজ্যতেল ছিল কাঠের ঘানি ভাঙ্গা সরিষার তেল। এর ওষুধি গুণাগুণের জন্য প্রাচীনকাল থেকেই আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে এই তেল। কাঠের ঘানি ভাঙ্গা সরিষার তেল যেমন প্রয়োজনীয় তেমন উপকারীও। ভারতীয় উপমহাদেশে খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ থেকে সরিষার ব্যবহার হয়ে আসছে। সরিষার তেল উদ্দীপক হিসেবে পরিচিত। অন্ত্রে পাচকরস উৎপাদনে সাহায্য করায় হজমপ্রক্রিয়া দ্রুত হয়। এ ছাড়া একই প্রক্রিয়ায় ক্ষুধা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। সর্বজনীনভাবে কাঠের ঘানি ভাঙ্গা সরিষার তেলের ব্যবহার দিন দিন কমে যাচ্ছে। তবে এই তেলের গুণাগুণ সম্পর্কে যাঁরা অবগত আছেন, তাঁরা নিয়মিতই ব্যবহার করে চলেছেন কাঠের ঘানি ভাঙ্গা সরিষার তেল।
ওমেগা আলফা ৩ ও ওমেগা আলফা ৬ ফ্যাটি অ্যাসিড, ভিটামিন ই ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের সমৃদ্ধ উৎস হওয়ায় সরিষার তেলকে স্বাস্থ্যকর তেল বলা হয়। বিভিন্ন ভোজ্য তেলের ওপর করা একটি তুলনামূলক সমীক্ষায় দেখা যায়, সরিষার তেল ৭০ শতাংশ হৃৎপিণ্ড–সংক্রান্ত রোগের ঝুঁকি কমায়। সরিষার তেল ব্যবহারে শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা হ্রাস পায়, যা হৃদ্রোগের আশঙ্কা কমিয়ে দেয়।
এ ছাড়া কাঠের ঘানি ভাঙ্গা সরিষার তেল ঠান্ডা ও কাশি উপশমে সহায়ক প্রমাণিত হয়েছে। যখন বুকে প্রয়োগ বা তার দৃঢ় সুবাস নিশ্বাসের মাধ্যমে নেওয়া হয়, এটা শ্বাসযন্ত্রের নালির থেকে কফ অপসারণেও সাহায্য করে। শুধু খাওয়ার জন্যই নয়, সরিষার তেল চুল ও ত্বকের যত্নেও কাজে লাগে।
কাঠের ঘানি ভাঙ্গা সরিষার তেল চুলের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। অকালে চুল সাদা হওয়া রোধ করে ও চুল পড়া কমায়। সরিষার তেলে প্রচুর ভিটামিন ও খনিজ থাকে। বিশেষ করে উচ্চমাত্রার বিটা ক্যারোটিন থাকে এতে। বিটা ক্যারোটিন ভিটামিন-এতে রূপান্তরিত হয়ে চুলের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। এ ছাড়া এতে আয়রন, ক্যালসিয়াম, ফ্যাটি অ্যাসিড ও ম্যাগনেশিয়াম থাকে, যা চুলের বৃদ্ধিতে অনেক সাহায্য করে। এ ছাড়া প্রতি রাতে চুলে সরিষার তেল মালিশ করে লাগালে চুল কালো হয়।
উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে
কাঠের ঘানি ভাঙ্গা সরিষার তেল পরিপাক, রক্ত সংবহন ও রেচনতন্ত্রের শক্তিশালী উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে। এ ছাড়া খাওয়ার পাশাপাশি বাহ্যিকভাবে শরীরে মালিশ করলে শরীরের রক্ত সঞ্চালন এবং ঘর্মগ্রন্থি উদ্দীপিত হয় এবং শরীরের তাপমাত্রা কমে।
ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়
কাঠের ঘানি ভাঙ্গা সরিষার তেলে গ্লুকোসিনোলেট নামক উপাদান থাকে, যা অ্যান্টিকারসিনোজেনিক উপাদান হিসেবে পরিচিত। তাই এটি ক্যানসারজনিত টিউমারের গঠন প্রতিরোধে সাহায্য করে। এর ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট কোলোরেক্টাল ও গ্যাস্ট্রোইন্টেস্টাইনাল ক্যানসার থেকে সুরক্ষাও প্রদান করে।
চুল পাকা রোধ করতে
কাঠের ঘানি ভাঙ্গা সরিষার তেলের পুষ্টি উপাদান, ভিটামিন, মিনারেল চুলের অকালপক্বতা রোধ করে থাকে। প্রতিদিন রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে এই তেল মালিশ করুন চুল এবং মাথার তালুতে যা আপনার চুল পাকা রোধ করবে।
ঠোঁটফাটা রোধ করে
ঠোঁট ফাটা খুব সাধারণ একটি সমস্যা। অনেকের এই সমস্যা এত বেশি হয়ে থাকে যে লিপবাম কাজ করে না। অল্প একটু সরিষার তেল নিয়ে ঠোঁটে লাগান। এই প্রাকৃতিক ময়েশ্চারাইজার ঠোঁটফাটা রোধ করে ঠোঁট নরম কোমল করে তোলে। শুষ্ক ঠোঁটের যত্নে সরিষার তেল ভালো কাজ করে। লিপবাম বা চ্যাপস্টিক—এগুলোর পরিবর্তে সরিষার তেল ব্যবহার করতে পারেন।
কার্ডিওভাসকুলার উপকারিতা
কাঠের ঘানি ভাঙ্গা সরিষার তেল মনোস্যাচুরেটেড ও পলিস্যাচুরেটেড ফ্যাটে সমৃদ্ধ বলে কোলেস্টেরলের ভারসাম্য রক্ষা করতে সাহায্য করে। এর ফলে কার্ডিওভাসকুলার রোগের ঝুঁকি কমে।
সতর্কতা
কাঠের ঘানি ভাঙ্গা সরিষার তেল ব্যবহারের আগে অবশ্যই নিশ্চিত হয়ে জেনে নিতে হবে যে আপনার সরিষার তেল খাঁটি কি না? নকল বা ভেজাল সরিষার তেল ব্যবহারের ফলে ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে বেশি। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আমাদের স্বাস্থ্যসুরক্ষায় কাঠের ঘানি ভাঙ্গা সরিষার তেল কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু যেকোনো সরিষার তেল কি আমাদের জন্য উপকার বয়ে আনবে? মোটেও তা নয়। দোকানের খোলা সরিষার তেলে ভেজাল মিশ্রিত থাকে, যা ব্যবহার করলে নানা রকম অসুখ–বিসুখ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই খাঁটি কাঠের ঘানি ভাঙ্গা সরিষার তেল কেনার ক্ষেত্রে সাবধান হতে হবে।
লেখক: প্রধান পুষ্টিবিদ, বিআরবি হাসপাতাল, ঢাকা
Reviews
There are no reviews yet.