দিনাজপুরের কাটারিভোগ ধানের ইতিহাসঃ
দিনাজপুরের স্বর্ণ প্রসূত লাল মাটি আর প্রকৃতির অকৃপণ দান এলাকাবাসীকে যেন স্নেহভরে তুলে দিয়েছিল এক বিশেষ সম্পদ “কাটারিভোগ” ধান। দিনাজপুরের মাটি ও মানুষ ধন্য সে সম্পদ পেয়ে। গর্বিত ও সম্মানিত দেশ বিদেশের কাছে। কাটারিভোগ ধান ছাড়াও এ জেলায় আরো নানা জাতের সুগন্ধি ধান জন্মে। তার মধ্যে ব্রি ধান-৩৪, জিরা কাটারী (চিনিগুঁড়া), ফিলিপিন কাটারি, চল্লিশ জিরা, বাদশা ভোগ, কালোজিরা, জটা কাটারি, চিনি কাটারি ও ব্রিধান-৫০ উল্লেখযোগ্য।
এ জেলার ঐতিহ্যবাহী “ কাটারিভোগ ধান” বাংলাদেশের যে কোন ধানের চেয়ে গুণগত মানের দিক থেকে উন্নত। কখন কিভাবে দিনাজপুর জেলার কাটারিভোগ ধানের উৎপাদন শুরু হয়েছিল তা” সঠিকভাবে জানা যায়নি, তবে বিভিন্নভাবে সংগৃহীত তথ্যে দেখা যায় যে, কাটারিভোগ দিনাজপুরের আদি ও অকৃত্রিম ধান, ইতিহাস থেকে জানা যায় আর্যদের এ দেশে আগমনের পূর্ব থেকেই এ অঞ্চলে এ ধানের উৎপাদন হতো এবং তখন থেকেই মাটি ও মাটির উর্বরতা বিশেষে সুগন্ধি যুক্ত কাটারিভোগ ধানের উৎপাদন শুরু হয়েছিল।
কাটারিভোগকে ঘিরে রয়েছে অনেক কিংবদন্তী, লোককথা, লোকগাঁথা ও কাহিনী গল্প। ছুরি যেমন মাথার দিকে চোখাও একটু খানি বাঁকা, কাটারিভোগ ধানও দেখতে ঠিক তেমনি এবং সুগন্ধি। কথিত আছে যে, এই উন্নত ধানের চাল দিয়েই দেবতাকে ভোগ দেওয়া হতো বলেই এর নামকরণ করা হয়েছে “কাটারিভোগ” দিনাজপুরের প্রতাপশালী রাজা প্রাণনাথের বিরুদ্ধে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের দরবারে দুর্নীতি, দুঃশাসন, দিল্লীর দরবারে রাজস্ব না পাঠানোর হঠকারিতা, মোগল আনুগত্য অস্বীকার ইত্যাদি অভিযোগ উত্থাপিত হলে সম্রাট রাজা প্রাণনাথকে তার দরবারে তলব করেন। ভীত সন্ত্রস্ত জমিদার প্রাণনাথ তার বিরুদ্ধে অভিযোগ খন্ডানোর উদ্দেশ্যে মোগল দরবারে উপযোগী বিপুল সংখ্যক উপঢৌকন নিয়ে যান। তার মধ্যে ঢাকার মসলিন, রাজশাহীর গরদ, বহু হীরা পান্না, জড়োয়, অলঙ্কার ও বিরাট অংকের স্বর্ণ মুদ্রা এবং দিনাজপুরের ঐতিহ্যবাহী সুরভিযুক্ত “কাটারিভোগ চাল” ও “চিড়া” সঙ্গে নিয়ে দিল্লীর দরবারে গমন করেন। এই সমস্ত উপঢৌকনাদি প্রাণনাথের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলি খন্ডাতে পুরোপুরি সাহায্য করে এবং তিনি সসম্মানে “রাজা” উপাধিতে ভূষিত হন। উপঢৌকন হীরা-পান্না, স্বর্ণমুদ্রা পেয়ে সম্রাট যত না খুশি হয়েছিলেন, তার চেয়ে বেশি মুগ্ধ হয়েছিলেন “কাটারিভোগ চাল” ও “চিড়া” পেয়ে। বর্তমান যুগেও এ জেলার মানুষ আত্মীয়-স্বজনকে খুশি করতে উপঢৌকন হিসেবে “কাটারিভোগ চাল” ও “চিড়া” পাঠাতে ভুল করেন না।
দেশি-বিদেশী বড় বড় মেহমান এবং রাষ্ট্র প্রধান ও কূটনীতিকরা এদেশে এলে কাটারীভোগ চালের পোলাও দিয়ে তাদের আপ্যায়ন করা হয়। পরিতৃপ্ত হয়ে অতিথিবৃন্দ সুগন্ধি চালের অকুণ্ঠ প্রশংসা করে থাকেন এবং চালের উৎস ও প্রাপ্তিস্থান সম্পর্কে কৌতুহল হয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে থাকেন। সুগন্ধি এবং মসৃণতার জন্য এখনও বিদেশে বিশেষ করে বৃটেন, আমেরিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে এর চাহিদা অপরিসীম। পোলাও ছাড়াও কাটারিভোগ চাল দিয়ে বিরানী, জর্দা পোলাও, পায়েশ, ফির্নী ও পিঠা সহ নানা প্রকার উপাদেয় খাবার তৈরি করা যায়। বাসমতি বা দাদখানি চালের চেয়ে উন্নত বলে সারা বিশ্বে এর চাহিদা রয়েছে ব্যাপক এবং এককালে এ চালের প্রধান বাজার ছিল কলকাতা।
অতীতে সুরভীযুক্ত কাটারিভোগের গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে তৎকালীন রাজা, জমিদারও সামন্ত প্রভুরা এই ধানের উৎপাদনের জন্য বিশেষভাবে তৎপর ছিলেন। তারা লাঙল বলদ ও গোবর সার দিয়ে কৃষকদের সর্ববিষয়ে সহায়তা ও উৎসাহিত করতেন। কাটারিভোগ উৎপাদনের ব্যাপারে গল্প প্রচলিত আছে যে ভাল ফলনের আশায় নাকি প্রথম বর্ষায় বীজ জমিতে ছিটিয়ে দিতো, লক্ষী দেবী সন্তুষ্ট হলে মৌ-মৌ সুগন্ধি ভরা সোনালী সরু ধানে গৃহ ভরে দিতো।
কাটারিভোগ ধান দিনাজপুরের ঐতিহ্য হলেও দিনাজপুরের সবখানেই এই ধানের চাষ হয় না। কাটারিভোগ ধান চাষের উল্লেখযোগ্য স্থানগুলো হচ্ছে- সদর উপজেলার ফাঁসিলাহাট, চিরির বন্দরের কাঁউগা, করিমুল্লাপুর, খানপুর, সদর উপজেলার ছোট বাউল, বড় বাউল, চিরিরবন্দর উপজেলার বাউগাঁও, বিষ্টপুর, তালপুকুর, ভিয়াইল, পশ্চিম বাউল, দুর্গাডাঙ্গা এবং কাহারোল উপজেলার কয়েকটি এলাকায়।
কাটারিভোগের জমিকে বার বার চাষ দিতে হয় এবং এই জমিতে মাত্র একবারই ফসল ফলানো সম্ভব। এই ঐতিহ্যবাহী ধানটির আরও বিশেষত্ব হলো এটা গোবর সার ছাড়া রাসায়নিক সারে হয় না। এর ফলন হয় প্রতি বিঘায় উর্ধ্বপক্ষে ৯/১০ মন। সাম্প্রতিক বিশ্বে বেড়ে যাওয়া মানুষের মুখের অধিক খাবার জোগানোর প্রয়োজনে কাটারিভোগ চাষের ব্যাপারে চাষীরা নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েছে।
Reviews
There are no reviews yet.